চারদেয়ালের মাঝে সুদর্শনা (Anthurium andraeanum)

অফিসে বা বাড়ীর ড্রইং রূমে একটু জীবন্ত সবুজের ছোঁয়া আমার খুবই পছন্দ। কিন্তু গাছ রোদ ছাড়া বাঁচে না। তাহলে আমার ফ্ল্যাট বাসায় বা অফিস রূমে গাছ রাখব কিভাবে? উপায় আছে ...। বেশ কয়েকটি দৃষ্টি নন্দন লতা ও গুল্ম জাতীয় গাছ আছে যা ঘরের সরাসরি সূর্যের আলো ছাড়া পরিবেশে রেখে বড় করা যায়। Anthurium এমনই এক ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ যার বেড়ে ওঠার জন্য সরাসরি সূর্যের আলো দরকার হয় না, দরকার নেই অতিরিক্ত পানি, অতিরিক্ত সার, কিংবা পরিচর্যা। আলোকিত ঘর আর সামান্য যত্নের বিনিময়ে Anthurium দেয় চকচকে সবুজ পাতার চমক আর আকর্ষণীয় রঙিন ফুল।

পরিচিতি – একবীজপত্রী (Monocots) উদ্ভিদ শ্রেণীভূক্ত Anthurium গণভূক্ত প্রায় ১০০০-এর কাছাকাছি প্রজাতি সণাক্ত করা গেছে। Anthurium এর আদি বাস মেক্সিকো থেকে আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে পর্যন্ত। অনেকে Anthurium–কে Flamingo flower (Flemingo Lily), Hawaiian love plant, Painter’s palette বা Tail Flower নামেও চেনেন, বাংলায় এটি সুদর্শনা নামে পরিচিত। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০টি প্রজাতির চাষ হয়। গাছটি গড়ে দেড় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে পট / টব পরিবর্তন করে কিংবা শিকড় ছাঁটাই করে প্রায় ১ ফুট আকারের ঝোপ হিসাবেও রাখা যায়। 
Anthurium রঙ্গিন সাজে সেজে ওঠে একটু উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায়। আমাদের দেশে বসন্ত থেকে শরৎকাল পর্যন্ত Anthurium –এর ফুল ফোটার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজ করে। Anthurium –এর পাতা দেখতে হরতনের মতো। এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ এর উজ্জ্বল বর্ণের “ফুল”। আসলে এর ফুল হ’ল সাদা ও হলদে বর্ণের পুষ্পমঞ্জরী যা লম্বা দন্ডের বিন্যাসে সাজানো, আর এই ফুলের বিন্যাসকে ঘিরে রয়েছে দৃষ্টি আকর্ষক উজ্জ্বল রঙ্গিন “পাপড়ি”। ফুল দীর্ঘস্থায়ী। লাল প্রজাতির Anthurium বেশী জনপ্রিয় হলেও গোলাপী, কমলা ও সাদা রঙের Anthurium ও কম জনপ্রিয় নয়! হাওয়াই ও অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে Anthurium –এর রঙিন তোড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়। 

পরিচর্যা : 

উজ্জ্বল আলো : পর্যাপ্ত উজ্জ্বল আলোতে গাছটি তার সৌন্দর্য দেখাতে শুরু করে। তবে সরাসরি রৌদ্র এর জন্য ক্ষতিকর। সুতরাং আলোকিত স্থান যেমন ঘরের জানালার কাছে, বা বারান্দার যেখানে রোদ আসে না, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসযুক্ত অফিস কক্ষ কিংবা ড্রইং রূম Anthurium – এর জন্য অতুলনীয়। যে পরিমাণ স্বাভাবিক আলোতে এই বই ভালোভাবে পড়া যায় সেই আলোই হলো Anthurium এর জন্য সঠিক পরিমাণ আলো। 

আর্দ্র পরিবেশ : আমাদের দেশে শীতকাল ছাড়া সারাবছরই মোটামুটি আদ্র পরিবেশ থাকে। আদ্রতা যদি ৫০% এর নিচে নেমে আসে তবে টবের চারিদিকে বাতাসে পানি স্প্রে করা যেতে পারে। 


টবের মাটি পরিবর্তন ও সার প্রয়োগ : গাছের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ও টবের মাটি গাছের উপযোগী রাখতে টবের মাটি প্রয়োজন মত পরিবর্তন করা প্রয়োজন। গাছটির চারপাশের টবের মাটি সাবধানে সরিয়ে সেই মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে আবার টবে দেয়া যেতে পারে। মাটিতে পর্যাপ্ত ফসফেট জাতিয় সার দিলে ফুলের রঙ বেশি উজ্জ্বল হয়। অপরদিকে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে প্রতি দুই সপ্তাহে একবার দুইভাগ পানিতে একভাগ ফসফেট সার মিশিয়ে সেই তরল টবের মাটিতে দিলেও ফুলের রঙ উজ্জ্বল ও সংখ্যায় বেশী হবে। টবে গাছ বসানোর সময় কিছু শিকড় কেটে দেয়া যেতে পারে। তাতে গাছটি ছোট থাকবে। আবার গাছের গাড়ার শক্ত কন্দের (রাইজোম) কিছুটা সাবধানতার সাথে কেটে আলাদা টবে লাগালে সেখান থেকে নতুন গাছ তৈরী হবে। 


পরিচ্ছন্নতা ও পানি প্রদান : পাতা মাঝে মাঝে ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে দিলে, পাতার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পাবে। তবে, পাতায় পানির ফোটা জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাতায় জমে থাকা পানি থেকে বাদামী পচা রোগ হতে পারে। তবে এই রোগ উপযুক্ত ছত্রাকনাশক দ্বারা নিরাময় করা যায়। Anthurium অতিরিক্ত সহ্য করতে পারে না। একারণে তলায় ছিদ্রযুক্ত টবে এই গাছ লাগাতে হয়। ছিদ্র থাকার কারণে অতিরিক্ত পানি চুঁইয়ে বের হয়ে যেতে পারে। মাটিতে প্রয়োজনীয় পানি আছে কি না বুঝতে হলে, টব থেকে এক মুঠি মাটি নিয়ে জোরে মুঠি টিপে ধরলে যদি হাতের তালু হালকা ভিজা অনুভব হয়, তবে বুঝতে হবে পানি দেয়ার দরকার নেই। 

পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য টব বা পাত্রের নিচে ট্রে রেখে তাতে পাথরের টুকরো ছড়িয়ে দিয়ে পানি দিয়ে রাখলে গাছের চারিদিকে সঠিক আর্দ্রতা বজায় থাকবে। 

Anthurium পাতার কিনারা  বাদামী বা হলুদ হয়ে আসলে বুঝতে হবে গাছটি সঠিক আর্দ্রতা বা সঠিক পরিমান আলোর মধ্যে নেই।



ফুল ফোটানর জন্য করণীয় : Anthurium তার উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই ফুল দিতে শুরু করে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, Anthurium ভালভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ পেলে বছরে চার থেকে ছয়বার ফুল প্রদান করে। পূর্ণ বয়স্ক গাছে, ছোট গাছের তুলনায় ঘনঘন বড় আকারের ফুল আসে। এক একটি ফুল ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত গাছে থাকে। ফুলদানিতে পানি দিয়ে, সেই পানিতে ফুলের কাটিং কয়েক সপ্তাহ তাজা থাকে। ঘরে Anthurium -কে ভাল রাখতে ও ফুল ফোটাতে যা করা দরকার- 

  • ঘরে পর্যপ্ত প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা। 
  • উপযুক্ত পরিমাণ আদ্র পরিবেশ বজায় রাখা। আদ্রতা কমে গেলে গাছের আসেপাসে পানি স্প্রে করে বা পাতা ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে আদ্রভাব তৈরী করা যায়। 
  • গাছ ছিদ্র যুক্ত টবে লাগানো দরকার। টবের ছিদ্র দিয়ে যেন অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। 
  • গাছ ভালভাবে বেড়ে ওঠার জন্য হালকা ভিজা / আদ্র মাটি ভাল। মাটি মোটামুটি শুকিয়ে আসলে পানি দেয়া উচিত। 
  • দো-আঁশ মাটি, জৈব / গোবর সার ও ফসফরাস যুক্ত মাটি টবে লাগানো Anthurium-এর ফুল ফোটার জন্য উপযুক্ত। মাসে একবার টবের মাটি পরিবর্তন করে, মাটিতে পুষ্টির পরিমাণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 
  • দুই বছরে একবার গাছকে নতুন টবে নতুন করে লাগানো দরকার। এ সময় অতিরিক্ত শিকড় কেটে দেয়া, কন্দ সাবধানে ভাগ করে গাছকে ছোট করে নতুন টবে লাগালে গাছ আবার নতুন করে বেড়ে ওঠে। 
সতর্কতা : কচু গাছের পাতার মত Anthurium এর পাতায়ও ক্যালসিয়াম অক্সালেট দানা থাকে, যা প্রাণীর গলায় জ্বালা সৃষ্টি করে। পাতার রস হাতে লাগলে হাত চুলকাতে পারে। সুতরাং, তৃণভোজী প্রাণী এবং শিশুদের হাত থেকে এই গাছ দুরে রাখা দরকার। সেইসাথে, গাছ পরিচর্যার সময় হাতে পলিথিন গ্লাভস পরা নিরাপদ। 


বর্তমানে সুদর্শনা বা Anthurium শহরের সকল নার্সারিতে পাওয়া যায়। দুই-একটি নার্সারী হয়ত অন্যনামে গাছটি বিক্রি করে। সেকারণে এই Post এর ব্যানারের ছবিটি দেখালে সঠিক গাছটি চিনতে ভুল হবে না। নাগরিক জীবনে ইট সিমেন্টের মাঝে থেকে, নিজের হাতে ফোটানো একগুচ্ছ লাল সুদর্শনা (Anthurim)  হতে পারে প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার। 





Comments

Popular posts from this blog

চারদেয়ালের মাঝে বোস্টন ফার্ন (Nephrolepis exaltata)

চারদেয়ালের মাঝে পিস লিলি (Spathyphyllum sp.)